চন্দ্রবোরা সাপ - Russell's Viper
চন্দ্রবোরা সাপটি স্কটিশ সরীসৃপবিদ প্যাট্রিক রাসেলের সম্মানে রাসেল ভাইপার ( Russell's Viper ) নাম রাখা হয়েছে । আঞ্চলিক ভাবে এরা উলুবোড়া নামেও পরিচিত। ইংরেজিতে একে Daboia Snake ও বলা হয়। সাপটির বৈজ্ঞানিক নাম Daboia russelii , এটি Viperidae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।
আকার ও আক্রিতিঃ চন্দ্রবোরা দেখতে অনেকটা অজগরের মত। এদের দেহের মূল রং বাদামি। সারা দেহে গাঢ় বাদামি বরফি এর মতো আছে , বরফি গুলো কোনটি গোলাকার কোনটি ডিম্বাকার। এই বরফিগুলো সাদা-কালো বর্ডার দেয়া। উপমহাদেশের ছোবল মারা সাপের মধ্যে চন্দ্রবোড়া সাপের দাঁত অস্বাভাবিক বড় প্রায় ১৬ মিমি। চন্দ্রবোড়া পৃথিবীর দ্বিতীয় বড় বিষদাত যুক্ত সাপ, যে কারনে এই সাপের প্রতিটা কামড় বিষ যুক্ত, ড্রাই বাইট হয় না। লম্বার তুলনায় দেহ বেশ নাদুস-নুদুস। এরা লম্বায় ১০০ - ১৬০ সেমি পর্যন্ত হয়। তবে কখনো কখনো এরা ১৮০ সেমি পর্যন্তও হয়ে থাকে।
সভাবঃ প্রতিবছর পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ মারা যায় “রাসেলস ভাইপার” এর ধ্বংসনে । তাই বিশ্বে বিষধর সাপগুলোর তালিকায় ৫ নম্বরে অবস্থান করছে Russell's Viper । এই সাপটি ডাঙ্গায় যতটা চটপটে ,পানিতে ততোটা অসহায় । অন্যান্য সাপ যখন শীতকালে শীতনিদ্রায় থাকে, রাসেল ভাইপার তখন শীতকালে দিনের বেলাতেই বেশি প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠে , যদিও সাপটি নিশাচর । যার কারণে খুব সহজেই এরা মানুষের সংস্পর্শে চলে আসে।সাপটি যখন ভয় পায় তখন নিজেকে গুটিয়ে ফেলে ‘S’ লুপের আকার ধারন করে। এরা উত্তেজিত বা রাগান্বিত হলে শরীরের উপরের এক তৃতীয়াংশ উঁচু করে রাখে এবং উচ্চস্বরে হিস্ হিস্ করতে থাকে । এই হিস্ হিস্ শব্দ পৃথিবীর অন্য যেকোনো সাপ এর চেয়ে অনেক বেশি তীব্র। তাছাড়া এটি ক্ষিপ্র গতিতে ছোবল মারার জন্যও বিখ্যাত। তাই সাপটি কোনোক্রমে সামনে পড়ে গেলে অযথা বিরক্ত না কোরে সাবধানতার সহিত দূরে সোরে যাওয়া বুদ্ধি মানের কাজ । Russell's Viper মাটিতে থাকতেই পছন্দ করে কারণ এরা গাছে চড়তে অভ্যস্ত নয় । এ প্রজাতির সাপের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা দাঁত মুখের ভেতর ভাঁজ করে রাখতে পারে। কামড়ানোর সময় প্রয়োজনে দাঁত পেশির মাধ্যমে খাড়া করে নেয়।
Russell's Viper কে চতুর শিকারিও বলা যাইতে পারে , কারণ হোলো এরা ইঁদুরকে পেয়ে সাথে সাথে ভক্ষণ করে না । এরা ইঁদুরকে কামড় দিয়ে ছেরে দেয় । আক্রান্ত ইঁদুর ভয় পেয়ে তার গর্তের দিকে ছূটে চলে , Russell's Viper ও ইঁদুরের পিছু নিয়ে তাড় গর্তে চলে যায় । এতে গর্তে এক সাথে কয়েকটা ইঁদুর পেয়ে যায় ।
খাদ্যঃ পোকামাকড়,টিকটিকি,বেঙ,ইঁদুর ও ছোটো পাখিই এদের পছন্দের খাবার।
প্রজননঃ চন্দ্রবোড়ারা সাপ ডিম পাড়ে না সরাসরি বাচ্চা দিয়ে থাকে।মূলত মে থেকে জুলাই মাসে এরা বাচ্চা প্রসব করে, সংখ্যায় ৬-৬৩ টি পর্যন্ত হয়।
বসবাসঃ চন্দ্রবোড়া নিচু জমির ঘাসযুক্ত উন্মুক্ত পরিবেশে এবং কিছুটা শুষ্ক পরিবেশে বাস করতে পছন্দ করে । গর্ত বা বাসস্থানের আশেপাশেই এরা গুড়ে বেড়ায়।
অবস্থানঃ চন্দ্রবোড়া বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক সাপ। এটি এক সময় আমাদের দেশের সব অঞ্চলেই কমবেশি বিস্তৃত ছিল । জন সংখ্যা বারার কারনে বসতবাড়ি ও আবাদি জমি অধিক হারে ব্যাবহারের প্রয়োজন হয়ে পরে, এতে সাপ সহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী তাদের স্বাভাবিক চলা ফেরায় বিগ্ন গটে। এতে দিন দিন তাদের সংখ্যা কমতে থাকে। সচরাচর চোখে না পরায় ২০-২৫ বছর আগে সঠিক ভাবে অনুসন্ধান না করে কয়েকজন স্রদেও বন্যপ্রাণী বিদরা সাপটিকে আমাদের দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে ঘোষণা দেন। বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে রাজশাহী , চাপাইনবাবগঞ ও নওগাঁ জেলাতে রাসেল ভাইপার এর দেখা যাচ্ছে । কুয়াকাটার জেলেদের মুখেও কুয়াকাটাতে চন্দ্রবোড়া সাপের উপস্থিতি শুনা যায়। এই ছাড়া বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ ,সুন্দরবন, চাপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলাতে এই সাপ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
বৈশ্বিক অবস্থানঃ বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, চীনের দক্ষিণাংশ, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, বার্মা ও ইন্দোনেশিয়ায় পাওয়া যায়।
বিষের ধরণ ও বিষের ক্রিয়াঃ Russell's Viper Hemotoxic ধরনের Venomous বহন করে। Hemotoxic প্রানির রক্তের সেল গুলো ভেঙে দিয়ে রক্ত জমাট বেধে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ করে। এক কামড়ে রাসেলস ভাইপার ১৩০-২৬৮ মিলিগ্রাম বিষ ঢালতে পারে। রাসেলস ভাইপারের বিষ তীব্র হওয়ায় যেখানে কামড়াবে সেখানে প্রচণ্ড ব্যাথা করবে, প্রচুর রক্তক্ষরণ হবে, প্রস্রাব এর সাথে রক্ত যাবে,ব্লাড প্রেসার এবং হার্ট রেট কমে যাবে,ফলে আক্রান্ত স্থান খুব তাড়াতাড়ি অবশ হয়ে পড়বে।এবং আরও সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া গুলো হচ্ছে প্রচণ্ড ঘাম ঝরবে,রক্তবমি হবে এবং কিডনি বিকল হয়ে পড়বে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভয়ে হার্ট এট্যাক মৃত্যুর কারণ।
বাংলাদেশে রাসেলস ভাইপার এর এন্টিভেনোম সহজলভ্য নয়।এর এন্টিভেনোম সরকারি কোন মেডিকেল স্টোর এ পাওয়া যায় না। এই সাপ এর কামড়ের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি শধুমাত্র রাজশাহী মেডিকেল এবং ঢাকা আর চট্রগ্রাম এর কিছু নির্দিষ্ট হাসপাতাল এই আছে। এখন সম্প্রতি ইনসেপটা
ফারমায় এই সাপ এর এন্টিভেনোম পাওয়া যায়। তাওউ অনেক ব্যয় বহুল ।
প্রকৃতিতে এদের ভুমিকাঃ Russell's Viper এর বিষ অতান্ত মূল্যবান। অনেক রোগের ঔষধ ও অনেক রোগ নির্ধারণের পরীক্ষায় চন্দ্রবোড়ার বিষ ব্যবহৃত হয়। আর আমাদের দেশের ঔষধ কোম্পানি গুলো প্রতি বছর এই বিষ আমদানি করে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে।যদি সঠিক ভাবে এই বিষ সংগ্রহ করা যায় , তাহলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়।
এই ছাড়া বাস্তুতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে প্রকৃতির এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিবছর বীজতলা থেকে শুরু করে খাদ্যগুদাম পর্যন্ত ইঁদুরে বিনষ্ট করে উৎপাদিত খাদ্যশস্যের ৩০ শতাংশ।তাছারা ইঁদুর নিধনে যেই বিষ প্রয়োগ করা হয় সেই বিষের প্রভাবে অন্যান্য প্রাণীও আক্রান্তত হয়ে থাকে।এতে পরিবেশের মারাত্মক ভারসাম্য হানি হয়। এই বিষ খাদ্য বস্তুর মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে নানা বিধ মারাত্মক রোগের প্রভাব বিস্ততার করে , যা আর্থিক ও মানুষিক ভাবে ক্ষতি গ্রস্থ করে আমদেরকে । Russell's Viper ইঁদুর ও বিভিন্ন পোকামাকড় খেয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে।
সাবধানতাঃ সাপটি কোনোক্রমে সামনে পড়ে গেলে অযথা বিরক্ত না কোরে সাবধানতার সহিত দূরে সোরে যাওয়া বুদ্ধি মানের কাজ । প্রত্যেক বন্যপ্রাণীর একটা প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চলে। মানুষকে এড়িয়ে চলার প্রবণতাই এদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। আর Russell's Viper এর মানুষের বাসা-বাড়িতে ঢুকে পড়ার ঘটনা খুবেই কম।একটা ভুল ধারণা রয়েছে যে, সাপ টি মানুষ দেখলেই কামড়ানোর জন্য তেড়ে আসে এই কথাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কোন সাপ আঘাত প্রাপ্ত না হলে অথবা ভয় না পেলে কামড়ানোর চেষ্টা করে না।
বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল ২ অনুযায়ী প্রজাতিটি সংরক্ষিত। IUCN এই প্রজাতিটিকে Least concern বা ন্যূনতম বিপদ গ্রস্থ বলে ঘোষণা করেছে।
PC: 1. Mohammad Quamruzzaman Babu
3. Prosenjit Debbarma
1. তফসিল -২ ( রক্ষিত বন্যপ্রাণী ) উভচর , বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, জুলাই ১০,২০১২, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, পৃষ্ঠা- ১১৮৫০৮।
2. Amphibians and Reptiles of Bangladesh - M. Kamrul Hasan , M. Monirul H. Khan , M. Mostafa Feeroz
3. A Guide To Wildlife - M. Monirul H. Khan
4. Borhan Biswas Romon
5. উইকিপিডিয়া
চাঁপাইনবাবগঞ্জে , চাঁদপুর
ReplyDelete